Type Here to Get Search Results !

চাঁদ সরে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে, সুপারমুনের রহস্য মিলছে ব্যাখ্যায়

রাতদিন ওয়েবডেস্ক   - পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ চাঁদ ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, বিজ্ঞানীরা এই তথ্য বহু বছর ধরে লেজার রেঞ্জিং দিয়ে মেপে আসছেন। প্রতি বছরে প্রায় দেড় ইঞ্চি দূরত্ব বাড়ছে বলে গড় হিসাব দেখায়, এই মাপ নেওয়া হয় চাঁদের পৃষ্ঠে বসানো রিফ্লেক্টরে লেজার পাঠিয়ে আসা যাওয়ার সময় ধরে। পৃথিবী আর চাঁদের গড় দূরত্ব থাকে প্রায় ৩ লাখ ৮৫ হাজার কিলোমিটার, তবে কক্ষপথ গোল না হওয়ায় দূরত্ব কম বেশি হয়। চাঁদের কক্ষপথ সম্পূর্ণ করতে সময় লাগে প্রায় ২৭ দশমিক ৩ দিন, আর দূরত্বের ওঠানামা বেশি হলে পূর্ণিমায় চাঁদ বড় আর উজ্জ্বল দেখায়, যাকে আমরা সুপারমুন বলি। এই সবই বহু পর্যবেক্ষণ, গাণিতিক মডেল আর মহাকাশযানের স্থাপিত সরঞ্জামের ডেটা দিয়ে নিশ্চিত করা হয়েছে। এখনই ভয় পাওয়ার কিছু নেই, পরিবর্তন খুব ধীর গতির।

দূরত্ব বাড়ার মূল কারণ জোয়ার ভাটার টান, পৃথিবী আর চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের টানাপোড়েনে সমুদ্রের জোয়ার ভাটা তৈরি হয়। জোয়ারের জল পৃথিবীর ঘূর্ণনের চেয়ে খানিকটা এগিয়ে থাকে, এই জলের ঢেউ চাঁদের ওপর টর্ক তৈরি করে, ফলে চাঁদ তার কক্ষপথে সামান্য এগিয়ে যায়। এতে কক্ষপথের শক্তি বাড়ে, কক্ষপথ বড় হয়, আর গড় দূরত্বও ধীরে ধীরে বাড়ে। বিপরীতে পৃথিবীর নিজের ঘূর্ণন গতি খুব সামান্য কমে, তাই দিনের দৈর্ঘ্য অতি সূক্ষ্ম হারে বাড়ে। এই প্রক্রিয়া পদার্থবিজ্ঞানের কৌণিক ভরবেগ সংরক্ষণ আর জোয়ার ঘর্ষণের সহজ ব্যাখ্যায় বোঝা যায়। গত কয়েক দশকে প্রকাশিত গবেষণাগুলো এই ধীর পরিবর্তনের সঙ্গত প্রমাণ দিয়েছে।চাঁদের দূরত্ব বছরের পর বছর সমান থাকে না, কারণ কক্ষপথ উপবৃত্তাকার, তাই কখনও একটু কাছে, কখনও একটু দূরে। যখন দূরত্ব তুলনায় কম, তখন পূর্ণিমার চাঁদ বড় আর উজ্জ্বল লাগে, এটিই সুপারমুন নামে জনপ্রিয়। আবার দূরে গেলে আকার তুলনায় ছোট দেখায়, তবে খালি চোখে সূক্ষ্ম পার্থক্য ধরা কঠিন। গড় দূরত্বের তুলনায় এই ওঠানামা কয়েক দশ হাজার কিলোমিটার হতে পারে, যা জোয়ার ভাটার তীব্রতাকেও প্রভাবিত করে। এই পর্যবেক্ষণ বহু বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে রেকর্ড করা হয়েছে। তাই বিষয়টি আজ আর অনুমান নয়, পরীক্ষায় যাচাই করা সত্য।

বিজ্ঞানীদের আশ্বাস স্পষ্ট, এই পরিবর্তন আমাদের জীবদ্দশায় বা বহু হাজার বছরেও বড় কোনো তাৎক্ষণিক প্রভাব ফেলবে না। বছরে দেড় ইঞ্চি দূরত্ব বাড়া গড় হিসাবের তুলনায় অতি সামান্য, শতাংশে ধরলে তা শূন্যের কাছাকাছি। দিনের দৈর্ঘ্যও যতটা বাড়ছে, তা মানুষের দৈনন্দিন জীবনে ধরা পড়ে না, পরিমাপে বোঝা যায়। তবে ভূতাত্ত্বিক কালে, লাখ কোটি বছরের স্কেলে, এই ধীর পরিবর্তনের প্রভাব জমতে থাকে। এমন দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানীরা মডেল তৈরি করে ভবিষ্যৎ অনুমান করেন। সেগুলোতে বড় ছবিটা ধীরে বদলানোর ইঙ্গিতই মেলে।প্রাচীন কালে চাঁদ ছিল আরও কাছে, পৃথিবীর দিনও ছিল ছোট, এ নিয়ে বিস্তর গবেষণা আছে। গ্রহ গঠনের শুরুতে জোয়ার ঘর্ষণ বেশি ছিল, তাই দূরত্ব দ্রুত বাড়ত, পরে হারে কমেছে। সময়ের সঙ্গে চাঁদের কক্ষপথ স্থিতিশীল হয়েছে, দূরত্ব বৃদ্ধির হার এখন ধীর। এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়া বুঝতেই লেজার রেঞ্জিং, প্রতিফলক, সিসমিক ডেটা, জ্যোতির্বিদ্যার পর্যবেক্ষণ কাজে লাগে। একই ছবিতে পৃথিবীর ঘূর্ণনও একটু একটু করে মন্থর হয়। এই সামগ্রিক পরিবর্তনই দিনের দৈর্ঘ্যে ক্ষুদ্র বৃদ্ধি হিসেবে ধরা দেয়।

দূর ভবিষ্যতের প্রশ্নে বিজ্ঞানীরা বলেন, চাঁদ পুরোপুরি আলাদা হয়ে যাবে কি না, এই কৌতূহল স্বাভাবিক, কিন্তু সূর্যের জীবনচক্র বড় চিত্র বদলে দেবে। সূর্য লাল দানবে পরিণত হওয়ার বহু আগে থেকেই পৃথিবীর সমুদ্র, বায়ুমণ্ডল, তাপমাত্রা সব বদলে যাবে, বাসযোগ্যতার সমীকরণ পাল্টাবে। তাই চাঁদের ধীর সরে যাওয়া তার আগেই অন্যান্য জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক পরিবর্তনে ঢাকা পড়ে যাবে। বড় সময়স্কেলের এই গল্পে দূরত্ব বাড়া একটি অংশ মাত্র। মোটের ওপর বর্তমান যুগে এতে আতঙ্কের কারণ নেই।এখন প্রশ্ন, কে ঠেলছে চাঁদকে, উত্তর জোয়ার ভাটার পদার্থবিদ্যা। সমুদ্রের স্ফীতি পৃথিবীর ঘূর্ণনের সঙ্গে সামান্য ফেজ পার্থক্য তৈরি করে, সেখান থেকেই টর্ক, কক্ষপথে শক্তি সঞ্চার, আর সামান্য ত্বরণ। এই টানই দীর্ঘ সময়ে কক্ষপথ বড় করে, ফলে গড় দূরত্ব বাড়ে। এটি একই সঙ্গে পৃথিবীর ঘূর্ণন থেকে কক্ষপথে ভরবেগ বণ্টনের প্রক্রিয়া। এই বোঝাপড়া আজ বহু উৎসে একমত। তাই পর্যবেক্ষণ আর তত্ত্ব পাশাপাশি মিলছে।

যে মাপ আমরা বলি, দেড় ইঞ্চি প্রতি বছর, তা গড় মান, সময়ের সঙ্গে ওঠানামা হয়। ভূগর্ভের গঠন, মহাসাগরিক বেসিন, বরফ আচ্ছাদন, জলের বণ্টন, এগুলোও টিডাল ডায়নামিক্সে পার্থক্য আনে। তাই বছরভেদে সামান্য ফারাক দেখা যায়, তবে দীর্ঘ গড় ছবিটা একই থাকে। বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক এই মাপ জুড়ে মিলিয়ে দেখে। ফল মিললে সেটাই গ্রহণযোগ্য মান হয়ে ওঠে। এই যাচাই বারবার করা হয়।প্রসঙ্গত, সুপারমুনের সময়ে আকার বড় দেখা গেলেও, খালি চোখে পার্থক্য বোঝা কঠিন, ছবিতে তুলনা করলে পার্থক্য স্পষ্ট হয়। জোয়ারের টানে তখন জলস্তরের পরিবর্তনও একটু বেশি হতে পারে, এর স্থানীয় প্রভাব থাকে। আবহাওয়া, চাপ, বাতাস, উপকূলের আকৃতি জুড়ে মোট প্রভাব নির্ভর করে। তাই একটি রাতে সবখানে একই প্রতিক্রিয়া হয় না। স্থানীয় প্রশাসন তখন সতর্কতা জারি করে থাকে। বিজ্ঞানীরা এখানে জ্যোতির্বিদ্যা আর উপকূলবিজ্ঞানের যৌথ ব্যাখ্যা দেন।

চাঁদের কক্ষপথ ২৭ দশমিক ৩ দিনে সম্পূর্ণ হলেও, একই ফেজে, যেমন পূর্ণিমা থেকে পূর্ণিমা, ফিরতে লাগে প্রায় ২৯ দশমিক ৫ দিন, এটিই আমরা চান্দ্রমাস হিসেবে চিনি। ফেজ নির্ভর এই সময় আর কক্ষপথ নির্ভর সময় আলাদা, তাই ক্যালেন্ডারের হিসাবেও ফারাক থাকে। এই পার্থক্যই আমদের উৎসবের তারিখে চলতি বদল আনে। আকাশে চলার এই ছন্দ বহু সভ্যতার গল্পে বোনা আছে। বিজ্ঞান সেই ছন্দকে সংখ্যায় ধরেছে। পর্যবেক্ষণ এখানে সবচেয়ে বড় শিক্ষক।দীর্ঘকালের ডেটা বলছে, পৃথিবীর দিনের দৈর্ঘ্য খুব ধীরে বাড়ছে, তবে তা এত ক্ষুদ্র যে মানুষের জীবনে অনুভব করা অসম্ভব। ভূতাত্ত্বিক স্তরে, প্রাচীন প্রবাল বা গাছের আবরনে দিনের সংখ্যা ধরে বছর গণনার প্রমাণ মেলে। সেসব রেকর্ডে দেখা যায়, বহু কোটি বছর আগে বছরে দিনের সংখ্যা ছিল বেশি, মানে দিন ছিল ছোট। আজ দিন লম্বা, আগামীতে আরও লম্বা হবে, তবে ধীর গতিতে। চাঁদের টান এই গল্পের নীরব চরিত্র।

এই সব তথ্যের ভিত্তি আন্তর্জাতিক সংস্থা আর মহাকাশ সংস্থার প্রকাশিত রিসোর্স, এগুলো নিয়মিত আপডেট হয়। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি, জনপ্রিয় বিজ্ঞান প্ল্যাটফর্ম, আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সংস্থাগুলোর ব্যাখ্যা এক জায়গায় এসে মিলে। সংখ্যাগুলো সামান্য পরিবর্তিত হতে পারে, কারণ মাপের পদ্ধতি আর সময়সীমা ভিন্ন হয়। তবে ট্রেন্ড একই, দূরত্ব বাড়ছে, দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে। মূল নীতিতে মতভেদ নেই। এই ঐক্যই বিজ্ঞানের শক্তি।কথা থাকে, একদিন কি ২৫ ঘণ্টায় পৌঁছবে দিন, এই প্রশ্নে বিজ্ঞানীরা সতর্ক, সময়স্কেল বিশাল, মডেলে অনিশ্চয়তা থাকে। তবে দিকটা বোঝা যায়, ধীরে ধীরে দিন লম্বা হচ্ছে। সামাজিক জীবনে বা প্রযুক্তিতে এর তাত্ক্ষণিক প্রভাব নেই। পৃথিবীর জলবায়ু, প্লেট টেকটোনিক্স, সূর্যচক্র, এ সবই সময়ের সঙ্গে বড় প্রভাব ফেলে। তাই একটি মেট্রিক ধরে বড় সিদ্ধান্ত হয় না। বিজ্ঞান সমগ্রটা দেখেই কথা বলে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad