রাতদিন ওয়েবডেস্ক - কলকাতা হাইকোর্ট মুর্শিদাবাদের ওয়াকফ সংশোধনী আইনবিরোধী আন্দোলনে হওয়া সংঘর্ষ মামলায় রাজ্যের ভূমিকা নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। বিচারপতি সৌমেন সেন ও বিচারপতি রাজা বসু চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চ বৃহস্পতিবার শুনানিতে প্রশ্ন তোলে, দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষে ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দিতে কেন অনীহা দেখাচ্ছে রাজ্য। বেঞ্চের মন্তব্য, দুর্গাপুজোয় অনুদান দিতে সমস্যা হয় না, অথচ ব্যক্তিগত ক্ষতির ক্ষতিপূরণে এত দেরি কেন।
ঘটনার সূত্র এপ্রিল ২০২৫, যখন ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনকে কেন্দ্র করে মুর্শিদাবাদের সুতী, সামশেরগঞ্জ, ধুলিয়ান ও জঙ্গিপুরে বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। শান্তিপূর্ণ মিছিল দ্রুত হিংসায় রূপ নেয়, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, এমনকি প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। সরকারি হিসাবে তিনজন নিহত হন, বহু বাড়িঘর ও দোকান পুড়ে যায়, শতাধিক পরিবার বাস্তুচ্যুত হয়। আদালতে এনআইএ তদন্তের প্রসঙ্গও ওঠে, কিন্তু বেঞ্চ জানায়, বারবার বলার পরও এনআইএ দায়িত্ব নেয়নি।রাজ্যের পক্ষে আইনজীবী শীর্ষণ্য বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, মোট ১০৯টি মামলা রুজু হয়েছে, ১১২টি চার্জশিট দাখিল হয়েছে, ২৫ জন অভিযুক্ত পলাতক। ক্ষতিগ্রস্তদের আইনজীবী প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়াল ক্ষতিপূরণের প্রসঙ্গ তুললে রাজ্য জানায়, ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ না হওয়ায় এখনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। এই জবাবে বিচারপতি সেনের তির্যক মন্তব্য, দুর্গাপুজোয় পুনর্বাসন দেওয়া যায়, আর এখানে পারছেন না।
আদালত অন্তর্বর্তী নির্দেশ বহাল রেখেছে। রাজ্যকে ক্ষতিপূরণের বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাতে হবে এবং তদন্তের অগ্রগতি রিপোর্ট পরবর্তী শুনানিতে পেশ করতে হবে। শুনানির তারিখ ধার্য হয়েছে ২০ নভেম্বর।বিচারপতিরা এদিন রাজ্যের আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন, “যে পরিবারগুলি ঘর হারিয়েছে, দোকান হারিয়েছে, তাদের পুনর্বাসনের জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?” রাজ্যের তরফে কোনও নির্দিষ্ট পরিকল্পনার কথা জানানো হয়নি। আদালত জানায়, ক্ষতিপূরণ শুধু আইনি দায় নয়, এটি প্রশাসনিক সংবেদনশীলতারও প্রতিফলন।
প্রতিবাদকারীদের মধ্যে অনেকেই জানিয়েছেন, তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে নিজেদের দাবি জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা ও রাজনৈতিক উত্তেজনার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের উপস্থিতি সত্ত্বেও বহু জায়গায় হিংসা ঠেকানো যায়নি।ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে রয়েছেন ছোট ব্যবসায়ী, দিনমজুর, ও শিক্ষার্থী পরিবার। ধুলিয়ানে এক দোকানদার জানান, “আমার দোকানটা পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। এখন পরিবার নিয়ে রাস্তায়।” এই ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের পরও ক্ষতিপূরণ না পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে।
আইনজীবী টিব্রেওয়াল আদালতে বলেন, “রাজ্য সরকার দুর্গাপুজোয় কোটি কোটি টাকা অনুদান দেয়, অথচ বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য কোনও তহবিল গঠন করেনি।” এই বক্তব্যে আদালতও সহমত প্রকাশ করে। বেঞ্চ জানায়, “রাজ্যের অগ্রাধিকার ঠিক করা উচিত। উৎসব নয়, মানুষের জীবন আগে।”রাজনৈতিক মহলে এই মামলার প্রভাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছে, রাজ্য সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছে। তৃণমূলের পক্ষ থেকে পাল্টা দাবি, “আমরা তদন্তে সহযোগিতা করছি, কিন্তু বিষয়টি রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।” আদালত এই রাজনৈতিক টানাপোড়েনের বাইরে থেকে প্রশাসনিক দায়বদ্ধতার ওপর জোর দিয়েছে।