রাতদিন ওয়েবডেস্ক - সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি বি আর গাভাইয়ের একটি মন্তব্য ঘিরে শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক। অভিযোগ, মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোর জাভেরি মন্দিরে ক্ষতিগ্রস্ত ৭ ফুট উচ্চতার বিষ্ণুমূর্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে দায়ের হওয়া এক জনস্বার্থ মামলার শুনানিতে তিনি এমন মন্তব্য করেছেন, যা হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত করেছে বলে মনে করছেন মামলাকারী ও আইনজীবীদের একাংশ।ঘটনা সূত্রে জানা যায়, রাকেশ দেশাই নামে এক ব্যক্তি দাবি করেন, মোঘল আমলে ক্ষতিগ্রস্ত ওই বিষ্ণুমূর্তির সংরক্ষণ ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মন্দির কর্তৃপক্ষ ও আর্কিওলজি সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কাছে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু কোনও সদিচ্ছা না থাকায় তিনি সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন।
শুনানিতে প্রধান বিচারপতি গাভাই মামলাটিকে গুরুত্ব না দিয়ে মন্তব্য করেন, “এটা স্পষ্টই প্রচারের লোভে করা মামলা। বিষয়টি এএসআই-এর অধীনে পড়ে। তাছাড়া আপনি তো বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত, যান গিয়ে বিষ্ণুকেই বলুন, যদি তিনি কিছু করতে পারেন। যান যান প্রার্থনা করুন।”এই মন্তব্য আদালতে উপস্থিত মামলাকারী ও আইনজীবীদের একাংশের ক্ষোভের কারণ হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, দেশের প্রধান বিচারপতির মুখে এমন মন্তব্য শোভা পায় না এবং এটি সনাতনী ভাবাবেগে আঘাত করেছে।মামলাটি খারিজ করে দেওয়ার পাশাপাশি প্রধান বিচারপতির এই মন্তব্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়তেই নিন্দার ঝড় উঠেছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, আদালতের শীর্ষপদে থাকা একজন বিচারপতির কাছ থেকে আরও সংযত ও নিরপেক্ষ আচরণ প্রত্যাশিত।এই ঘটনার পরপরই বিভিন্ন আইনজীবী সংগঠন এবং ধর্মীয় সংগঠন প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে শুরু করে। তাঁদের মতে, বিচারপতির মন্তব্য শুধু একজন ব্যক্তির ভাবাবেগে আঘাত করেনি, বরং এটি বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও মর্যাদাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে।
ভারতের আইনজীবী সংগঠন বার কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া এই বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে, যেখানে বলা হয়, বিচারপতির মন্তব্য অনভিপ্রেত এবং এটি আদালতের মর্যাদার পরিপন্থী। তাঁরা সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে এই বিষয়ে তদন্তের দাবি জানান।অন্যদিকে, কিছু আইনজীবী ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা প্রধান বিচারপতির মন্তব্যকে 'হালকা রসিকতা' হিসেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁদের মতে, বিচারপতির মন্তব্যকে অতিরিক্ত গুরুত্ব না দিয়ে মামলার মূল বিষয়বস্তুতে মনোযোগ দেওয়া উচিত।তবে এই বিতর্কের মধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে প্রধান বিচারপতির মন্তব্যের সময় আদালতের পরিবেশ এবং উপস্থিত আইনজীবীদের প্রতিক্রিয়া স্পষ্টভাবে দেখা যায়। ভিডিওটি দেখে অনেকেই মন্তব্য করেন, বিচারপতির বক্তব্যে রসিকতার ছাপ থাকলেও তা আদালতের গম্ভীর পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের অভ্যন্তরীণ আচরণবিধি ও বিচারপতিদের বক্তব্যের সীমা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, বিচারপতিদের উচিত তাঁদের মন্তব্যে আরও সংযত হওয়া এবং ধর্মীয় সংবেদনশীলতা সম্পর্কে সচেতন থাকা।
আইনি বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রধান বিচারপতির মন্তব্য বিচার ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা ও মর্যাদার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। প্রাক্তন বিচারপতি এ পি শাহ বলেন, "বিচারপতিরা আদালতের মর্যাদা রক্ষা করার দায়িত্বে থাকেন। এমন মন্তব্য বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের আস্থা কমিয়ে দিতে পারে।"আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং মন্তব্য করেন, "ধর্মীয় সংবেদনশীলতা নিয়ে বিচারপতিদের আরও সতর্ক হওয়া উচিত। আদালত একটি ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান, এবং বিচারপতিরা সেই নীতির ধারক।"আইন বিশেষজ্ঞ ফৌজিয়া খান বলেন, "এই ধরনের মন্তব্য মামলার মূল বিষয়বস্তু থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয় এবং বিচার ব্যবস্থার গাম্ভীর্যকে ক্ষুণ্ণ করে।"
আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, "বিচারপতিরা যদি রসিকতা করতে চান, তা যেন আদালতের পরিবেশ ও প্রসঙ্গের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়। নইলে তা অপব্যাখ্যার সুযোগ তৈরি করে।"এই বিশ্লেষণগুলো থেকে স্পষ্ট, প্রধান বিচারপতির মন্তব্য শুধু একটি মামলার প্রেক্ষিতে নয়, বরং বৃহত্তর বিচার ব্যবস্থার নৈতিকতা ও জনআস্থার প্রশ্নে আলোচনার দরজা খুলে দিয়েছে।