Type Here to Get Search Results !

সরকারি ছুটি উপেক্ষা করে খোলা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, উপাচার্যের সিদ্ধান্তে তুমুল বিতর্ক

রাতদিন ওয়েবডেস্ক — বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে রাজ্য সরকার আজ সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আজ খোলা রয়েছে। শুধু তাই নয়, আজই স্নাতকোত্তরের দ্বিতীয় দফার ভর্তির কাউন্সেলিংও নির্ধারিত হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত ঘিরে শিক্ষামহল থেকে প্রশাসনিক স্তর পর্যন্ত তুমুল বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তে শিক্ষক সংগঠন থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ক্ষোভের সুর শোনা যাচ্ছে। রাজ্যের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে তুলনা করলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবেই আলাদা। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ থাকতে পারে।

ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য শান্তা দত্ত দে স্পষ্ট জানিয়েছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগে কখনও বিশ্বকর্মা পুজো উপলক্ষে ছুটি পালিত হয়নি। তাঁর বক্তব্য, রাজ্যের অর্থ দপ্তর ও উচ্চশিক্ষা দপ্তর যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে পৌঁছায়নি। তিনি মনে করিয়ে দেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, তাই তারা নিজস্ব সিদ্ধান্তেই চলবে। নবান্নের তরফে প্রকাশিত নির্দেশিকায় এ বছরের সরকারি ক্যালেন্ডারে বিশ্বকর্মা পুজোর ছুটি স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল। সেই অনুযায়ী যাদবপুর, রবীন্দ্রভারতী ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করেছে। কিন্তু এই সারিতে একমাত্র ব্যতিক্রম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষামহলের একাংশ মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে রাজ্য সরকার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যে অস্বস্তিকর সম্পর্ক তৈরি হয়েছে, এই সিদ্ধান্ত তা আরও প্রকাশ্যে নিয়ে এল।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন থেকেও অসন্তোষের সুর শোনা যাচ্ছে। টিচার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সনাতন চট্টোপাধ্যায় জানান, সিদ্ধান্ত নিয়ে আপত্তি থাকলেও আপাতত মন্তব্য থেকে বিরত থাকছেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এ বিষয়ে কিছু বলতে চাননি। ফলে বিতর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। সরকারি ক্যালেন্ডারে স্পষ্টভাবে ছুটি উল্লেখ থাকলেও, সেটি উপেক্ষা করে ভর্তি প্রক্রিয়া চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকমহল থেকে প্রশাসনিক স্তর পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্ক ঘিরে যে টানাপড়েন চলছিল, বিশ্বকর্মা পুজোর ছুটি বিতর্ক তাতে নতুন অধ্যায় যোগ করল।

বিশ্বকর্মা পুজো পশ্চিমবঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব যা বিশেষভাবে কারিগর এবং শ্রমিক সমাজের কাছে পবিত্র। এই দিনে সাধারণভাবে সব ধরনের কাজকর্ম বন্ধ থাকে এবং মানুষ পূজার্চনায় মগ্ন থাকেন। রাজ্য সরকার এই বছর পরিযায়ী শ্রমিকদের সম্মানে এই ছুটি ঘোষণা করেছিল বলে জানা যায়। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্ত এই সাংস্কৃতিক পরিবেশের সাথে খাপ খায় না বলে অনেকের মতামত। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুভূতির প্রশ্নও এসেছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিকটিও বিবেচনা করা উচিত। সমাজের একটি বড় অংশ এই সিদ্ধান্তকে সংস্কৃতির প্রতি অবহেলা হিসেবে দেখছেন।

রাজ্য সরকার এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হওয়া টানাপড়েনের নতুন উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে এই ঘটনাকে। গত কয়েক মাস ধরে বিভিন্ন ইস্যুতে দু পক্ষের মধ্যে মতপার্থক্য দেখা যাচ্ছে। বাজেট বরাদ্দ থেকে শুরু করে নিয়োগ প্রক্রিয়া পর্যন্ত নানা বিষয়ে দ্বিমত রয়েছে। শিক্ষাবিদরা মনে করছেন এই রাজনৈতিক টানাপড়েনের শিকার হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা একটি জটিল বিষয়। কিন্তু এর প্রভাব যাতে শিক্ষাব্যবস্থায় না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন এই ধরনের বিতর্ক শিক্ষার মানের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এই সিদ্ধান্তের আইনগত দিকটিও বিশ্লেষণের দাবি রাখে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় যদিও স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান কিন্তু এটি রাজ্য সরকারের অর্থায়নেই চলে। সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান সরকারি নির্দেশনা মানতে বাধ্য কিনা সেই প্রশ্নও উঠেছে। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে এই বিষয়টি আদালতেও যেতে পারে যদি কোনো পক্ষ আইনি পথ বেছে নেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কতটুকু স্বায়ত্তশাসন রয়েছে তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষকদের অধিকারের প্রশ্নও এসেছে। কিছু আইনি বিশেষজ্ঞ মনে করছেন এই ধরনের বিতর্কিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আদালতের শরণাপন্ন হওয়া যেতে পারে।

মিডিয়া এবং জনমতের প্রতিক্রিয়াও এই বিতর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এবং বেশিরভাগ মানুষ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষাবিদ তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। টেলিভিশন চ্যানেল এবং পত্রিকাগুলো এই বিষয়ে ব্যাপক কভারেজ দিয়েছে। জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে যে বেশিরভাগ মানুষ এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে। এই জনমতের চাপ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে পুনর্বিবেচনায় বাধ্য করতে পারে। অনেক বুদ্ধিজীবী এবং সুশীল সমাজের ব্যক্তিত্ব এই বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করছেন এই ধরনের সিদ্ধান্ত শিক্ষার পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সমাধানের দিক নিয়ে এখনও স্পষ্টতা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের সিদ্ধান্তে অটল থাকার কথা জানিয়েছে। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাপের মুখে তারা কোনো পরিবর্তন আনবেন কিনা সেটা দেখার বিষয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকেও এখনও কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। শিক্ষামন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী কেউই এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য রাখেননি। এই নীরবতা আরও বেশি করে প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। আগামী দিনগুলোতে এই পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয় সেটা দেখার বিষয়। অনেকেই আশা করছেন যে একটি সমঝোতার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি।

শিক্ষার মান এবং প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তির উপর এই বিতর্কের প্রভাব নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের একটি অন্যতম পুরানো এবং মর্যাদাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠান। এই ধরনের বিতর্ক প্রতিষ্ঠানের সুনাম ক্ষুণ্ণ করতে পারে। আন্তর্জাতিক র্যাঙ্কিংয়ে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। শিক্ষার্থীরা ভর্তির সময় এই বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে পারেন। শিক্ষকদের মনোবলও এর ফলে প্রভাবিত হতে পারে। গবেষণা কার্যক্রম এবং একাডেমিক পরিবেশে এর ছাপ পড়তে পারে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই ধরনের প্রশাসনিক বিতর্ক থেকে বেরিয়ে এসে শিক্ষা ও গবেষণার মূল কাজে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।

সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে এটি কেবল একটি ছুটির দিনের সিদ্ধান্ত নয় বরং আরও গভীর সমস্যার প্রকাশ। রাজ্য সরকার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সম্পর্কের জটিলতা এর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের প্রশ্নও এসেছে। একাডেমিক ক্যালেন্ডার নির্ধারণে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই ধরনের পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য একটি সুস্পষ্ট নীতিমালার প্রয়োজন রয়েছে। সব পক্ষের মধ্যে সমন্বয় ও আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান খুঁজে বের করা প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

Top Post Ad

Below Post Ad