রাতদিন ওয়েবডেস্ক - আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের শেষ দিন, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, মহালয়া। ভোর ৪টা ১০ মিনিটে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠের সুরে বাঙালির ঘুম ভাঙবে, শুরু হবে দেবীপক্ষের আনুষ্ঠানিক সূচনা। এই দিনেই শেষ হবে পিতৃপক্ষ, যা গত ১৬ দিন ধরে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে তর্পণ ও শ্রাদ্ধের মাধ্যমে পালন করা হয়েছে। হিন্দু শাস্ত্র মতে, পিতৃপক্ষের শেষ দিনে পূর্বপুরুষেরা তাঁদের বংশধরদের কাছ থেকে বিদায় নেন, আর দেবীপক্ষের শুরুতে মা দুর্গা কৈলাস থেকে পৃথিবীর পথে যাত্রা শুরু করেন।‘মহালয়া’ শব্দের অর্থ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা আছে। কেউ বলেন, এটি ‘মহান আলয়’—দেবীর আশ্রয়। আবার অনেকে বলেন, এটি পিতৃলোকের মহান আবাস। শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যায়, এই দিনটি দ্বিমুখী তাৎপর্যে ভরপুর—পূর্বপুরুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও দেবীর আগমনী বার্তা। তর্পণ মন্ত্রে দেবতা, ঋষি, পিতৃপুরুষ ও সকল জীবের তৃপ্তির কামনা করা হয়, যা কেবল পারিবারিক নয়, বিশ্বজনীন একাত্মতার প্রতীক।
মহালয়া শুভ না অশুভ—এই প্রশ্নে মতভেদ দীর্ঘদিনের। একদল মনে করেন, এটি শোকস্মৃতির দিন, তাই শুভ নয়। অপরপক্ষে অনেকে বলেন, যে কোনও শুভ কাজের সূচনায় পূর্বপুরুষকে স্মরণ করা হিন্দু সংস্কৃতির অংশ, তাই মহালয়াকে অশুভ বলা যায় না। আসলে, এই তিথি মিলনের প্রতীক—মানুষ ও পূর্বপুরুষ, মানুষ ও দেবশক্তির মধ্যে গভীর সংযোগের বার্তা দেয়।বাঙালির কাছে মহালয়ার আরেকটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হল ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠান। ১৯৩২ সালে আকাশবাণীতে শুরু হওয়া এই সম্প্রচার, ১৯৬৬ সালের সংস্করণে আজও শোনা হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠে চণ্ডীপাঠ, বাণীকুমারের লেখা ও পঙ্কজ মল্লিকের সঙ্গীতায়োজন—এই মেলবন্ধন ছাড়া মহালয়া কল্পনাই করা যায় না। ভোরবেলা এই অনুষ্ঠান না শুনলে দেবীপক্ষের সূচনা যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
২০২৫ সালের মহালয়া পড়েছে রবিবারে, যা একদিন পরই শুরু হবে শারদীয় নবরাত্রি। এই বছর মহালয়ার তিথি শুরু হবে ২১ সেপ্টেম্বর রাত ১২টা ১৬ মিনিটে এবং শেষ হবে ২২ সেপ্টেম্বর রাত ১টা ২৩ মিনিটে। কুটুপ মুহূর্ত ১১টা ৫০ থেকে ১২টা ৩৮, রোহিণা মুহূর্ত ১২টা ৩৮ থেকে ১টা ২৭, অপরাহ্নকাল ১টা ২৭ থেকে ৩টা ৫৩—এই সময়গুলো তর্পণ ও শ্রাদ্ধের জন্য শুভ।মহালয়ার মূল আচারগুলির মধ্যে রয়েছে তর্পণ, শ্রাদ্ধ ও পিণ্ডদান। গঙ্গা বা অন্য পবিত্র জলে জল, তিল, চাল ও ফুল অর্পণ করে পূর্বপুরুষের আত্মার শান্তি কামনা করা হয়। পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুরুষ সদস্য সাধারণত এই আচার সম্পন্ন করেন, কুশ ঘাসের আংটি পরে। পিণ্ডদানের পর কাক, গরু, কুকুরকে খাদ্য দেওয়া হয়, যা যমরাজের দূত হিসেবে পূর্বপুরুষের কাছে পৌঁছে যায় বলে বিশ্বাস।
এই দিনে ব্রাহ্মণ ভোজন, বস্ত্র ও দক্ষিণা প্রদানও প্রচলিত। দরিদ্র ও অভাবীদের খাদ্য, বস্ত্র ও অর্থ দানকে অত্যন্ত শুভ মনে করা হয়। অনেকেই পিপল গাছে জল, দুধ ও চিনি মিশিয়ে অর্পণ করেন এবং প্রদীপ জ্বালান। সন্ধ্যায় দুর্গা সপতশতী পাঠ বা দেবীর মন্ত্র জপও প্রচলিত।মহালয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মহাভারতের কর্ণের কাহিনি। জীবদ্দশায় কর্ণ সোনা দান করলেও খাদ্য দান করেননি, ফলে মৃত্যুর পর স্বর্গে তিনি সোনা পেলেও খাদ্য পাননি। ইন্দ্রের অনুগ্রহে তিনি ১৬ দিন পৃথিবীতে ফিরে এসে দরিদ্রদের খাদ্য দান করেন—এই সময়ই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত।
বাঙালির সাংস্কৃতিক পরিসরে মহালয়া মানে দুর্গাপুজোর কাউন্টডাউন শুরু। কুমোরটুলিতে দেবীর চোখ আঁকার ‘চক্ষুদান’ এই দিনেই হয়, যা মৃন্ময়ী প্রতিমাকে চিন্ময়ী রূপ দেয়। পাড়া মহল্লায় প্যান্ডেল সাজানোর কাজ তুঙ্গে ওঠে, দোকানে কেনাকাটার ভিড় বাড়ে, রাস্তায় উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে।মহালয়ার সকালে গঙ্গার ঘাটে তর্পণ করতে মানুষের ঢল নামে। সাদা ধুতি, গামছা পরে পুরুষেরা, শাড়ি পরে মহিলারা, হাতে ফুল, তিল, চাল নিয়ে নদীর জলে দাঁড়িয়ে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করেন। এই দৃশ্য শুধু ধর্মীয় নয়, এক সামাজিক মিলনক্ষেত্রও।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘শুভ মহালয়া’ বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ভোর থেকেই। তবে পণ্ডিতদের মতে, যেহেতু এই দিনটি পিতৃপক্ষের সমাপ্তি, তাই শুভেচ্ছা জানানোর আগে এর প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা জরুরি। অনেকেই মনে করিয়ে দেন, এটি আনন্দ ও শোকের মিলনক্ষণের দিন, তাই বার্তায় সেই সংবেদনশীলতা থাকা উচিত।মহালয়ার আরেকটি দিক হল দান ও সেবামূলক কাজ। অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এই দিনে খাদ্য বিতরণ, স্বাস্থ্য শিবির ও সামাজিক উদ্যোগ নেয়। বিশ্বাস করা হয়, এই দিনে করা সৎকর্মের ফল বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।২০২৫ সালের মহালয়া তাই শুধু একটি তিথি নয়, এটি বাঙালির আবেগ, ঐতিহ্য, ধর্মীয় আচার ও সাংস্কৃতিক উৎসবের এক অনন্য মেলবন্ধন। পিতৃপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনার এই সন্ধিক্ষণ বাঙালির জীবনে এক গভীর তাৎপর্য বহন করে, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে অটুট থেকেছে।
চণ্ডীপাঠের প্রতিটি স্তবক যেন ঘুম ভাঙায় অতীতের স্মৃতির আলোয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে উচ্চারিত মন্ত্রে জেগে ওঠে ধর্মীয় আবেগ। রেডিওর শব্দে ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে এক অলৌকিক অনুভূতি। বৃদ্ধ থেকে শিশু—সব বয়সের মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে অনুষ্ঠান। এই শ্রবণ শুধু ধর্ম নয়, এক সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। ভোরের অন্ধকারে আলো হয়ে আসে মহালয়ার ঐতিহ্যবাহী সুর। সাদা ধুতি পরে পুরুষেরা নদীর জলে দাঁড়িয়ে করেন শ্রদ্ধা নিবেদন। তিল, জল, ফুল হাতে পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে উচ্চারিত হয় মন্ত্র। ঘাটে কাকের ডাক, ধূপের গন্ধে তৈরি হয় এক পবিত্র আবহ। বৃদ্ধা মহিলা, তরুণ, শিশুরাও অংশ নেয় এই ধর্মীয় আচার। সাংবাদিকদের ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক সামাজিক মিলনের ছবি। এই দৃশ্য শুধু ধর্ম নয়, এক ঐতিহ্যবাহী মানবিক সংযোগ।
চক্ষুদানের সময় শিল্পীরা করেন মন্ত্রপাঠ, জ্বালান প্রদীপ। মৃন্ময়ী প্রতিমায় চিন্ময়ী রূপ আনতে হয় বিশেষ যত্নবান। চোখ আঁকার সময় শিল্পীর হাত যেন চালিত হয় ঈশ্বরচেতনায়। এই মুহূর্তে উপস্থিত দর্শনার্থীরা অনুভব করেন দেবীর আগমন। কুমোরটুলির গলিতে ছড়িয়ে পড়ে উৎসবের এক অনন্য আবহ। চক্ষুদান মানেই দুর্গাপুজোর আনুষ্ঠানিক সূচনার বার্তা।ভোর থেকেই পোস্ট হয় ‘শুভ মহালয়া’ বার্তা, ছবি, ভিডিও। তবে পণ্ডিতরা মনে করিয়ে দেন এর গভীর ধর্মীয় তাৎপর্য। শোক ও আনন্দের মিলনক্ষণের বার্তায় থাকা উচিত সংবেদনশীলতা। অনেকে লেখেন পূর্বপুরুষের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার কথা। দেবীপক্ষের সূচনায় শুভেচ্ছা জানানোর রীতি হয়ে উঠেছে জনপ্রিয়। এই ডিজিটাল বার্তা ছড়িয়ে দেয় ঐতিহ্য ও আবেগের সংযোগ। খাদ্য বিতরণ, স্বাস্থ্য শিবির, বস্ত্র দান হয় বিভিন্ন স্থানে। বিশ্বাস করা হয়, এই দিনে দান করলে ফল বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। সংস্থাগুলি মহালয়াকে মানবিকতার উৎসব হিসেবে তুলে ধরে। দরিদ্রদের মুখে হাসি ফোটাতে সক্রিয় হন বহু তরুণ স্বেচ্ছাসেবক। এই উদ্যোগ মহালয়ার ধর্মীয় আবহে যোগ করে মানবিক স্পর্শ।