রাতদিন ওয়েবডেস্ক - দিল্লিতে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের সদর দফতরে হাজির হলেন টলিউড অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরা, সঙ্গে ছিল কয়েকটি নথি ও চুক্তিপত্র, আজ সকাল সাড়ে এগারোটার কিছু পরেই তিনি দফতরে ঢোকেন। ইডির প্রশ্নের কেন্দ্রে থাকতে পারে সংশ্লিষ্ট বেটিং অ্যাপ সংস্থার সঙ্গে চুক্তির শর্ত, পারিশ্রমিকের কাঠামো, এবং প্রচারের সময়সীমা। সংস্থাটি বিজ্ঞাপনের অর্থ কোথা থেকে পেয়েছে, সেই উৎস নিয়েও প্রশ্ন তুলতে পারে তদন্তকারী সংস্থা। অভিনেতা অফিসে ঢোকার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে নীরব থাকেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কী হয়েছে তা নিয়ে এখনও কোনও আনুষ্ঠানিক বিবৃতি আসেনি। এদিনের জেরাকে কেন্দ্র করে দফতরে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ছিল। তদন্তকারীদের মতে, চুক্তি, ইনভয়েস, ব্যাংক ট্রেল, সব কিছু মিলিয়ে দেখা হবে। প্রয়োজন হলে অভিনেতাকে আবার তলব করা হতে পারে।
গতকাল একই মামলায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাক্তন সাংসদ ও অভিনেত্রী মিমি চক্রবর্তীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইডি, তাঁকেও বিজ্ঞাপন চুক্তি এবং পারিশ্রমিক সংক্রান্ত নথি আনতে বলা হয়েছিল। বলিউড অভিনেত্রী উর্বশী রাউতেলাকেও আজ সিবিআইয়ের সামনে আসার কথা থাকলেও, রিপোর্ট জমা দেওয়ার সময় পর্যন্ত তিনি বক্তব্য রেকর্ড করতে যাননি। এর আগে প্রাক্তন ক্রিকেটার সুরেশ রায়না ও শিখর ধাওয়ানকে একই বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। রবিন উথাপ্পাকে ২২ সেপ্টেম্বর ইডির সদর দফতরে হাজির হওয়ার সমন দেওয়া হয়েছে বলে খবর। তদন্তের পরিধি তাই বিনোদন ও ক্রীড়া, দুই জগতেরই একাধিক নামকে স্পর্শ করছে। কারও বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়নি, এই পর্যায়ে সবাইকে সাক্ষী হিসেবে ডাকা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদের ফোকাস রইছে আর্থিক লেনদেন ও বিজ্ঞাপনের দায়বদ্ধতা।
ইডির তদন্ত মূলত একাধিক অবৈধ অনলাইন বেটিং প্ল্যাটফর্মকে ঘিরে, অভিযোগ, নাম পাল্টে নতুন ব্র্যান্ডে তারা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, সামাজিক মাধ্যম ও সেলিব্রিটি প্রচারকে ব্যবহার করে ক্রমশ পৌঁছচ্ছে সাধারণ ব্যবহারকারীর কাছে। কর ফাঁকি, অর্থ পাচার, এবং বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। গত কয়েক মাসে প্রযুক্তি সংস্থা, মিডিয়া হাউস, এবং এজেন্সির প্রতিনিধিদেরও ডেকেছে ইডি। গত জুলাইয়ে গুগল এবং মেটার প্রতিনিধিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নোটিস গিয়েছিল। তদন্তকারীরা বলছেন, বিজ্ঞাপন খাতে কারা কীভাবে অর্থ দিয়েছে, সেই চেইনটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর্থিক ট্রেলের সঙ্গে সেলিব্রিটি কনট্র্যাক্ট মিলিয়ে দেখলে ছবিটা পরিষ্কার হবে। আইন ভাঙা প্রমাণ হলে আলাদা ধারায় পদক্ষেপ হতে পারে।
২০২৩ সালে কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক সংবাদপত্র, নিউজ চ্যানেল, বিনোদন চ্যানেল, অনলাইন নিউজ পোর্টাল, গুগল, ফেসবুক সহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মকে অনলাইন বেটিং অ্যাপের বিজ্ঞাপন না দেওয়ার পরামর্শ দেয়। তার পরও, বিভিন্ন সময়ে একাধিক তারকা এই ধরনের প্ল্যাটফর্মের প্রচারে দেখা গিয়েছেন, যা এখন তদন্তের আওতায়। নীতিগতভাবে নিষেধাজ্ঞা, ব্র্যান্ডিংয়ে নাম বদল, এবং বিজ্ঞাপনের দায়, তিনটি স্তরেই প্রশ্ন তুলছে সংস্থাগুলি। শিল্পের অংশীদারদের বক্তব্য, অনেক সময় ব্র্যান্ডের প্রকৃত কার্যক্রম গোপন থাকে, চুক্তিতে তা ধরা পড়ে না। তবে সাম্প্রতিক সমন ও জিজ্ঞাসাবাদ দেখাচ্ছে, যাচাই প্রক্রিয়া কড়াকড়ি হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের আগে ডিউ ডিলিজেন্স জোরদার করার কথাও উঠছে। ব্র্যান্ড বাছাইয়ে এথিক্স কোডের দাবি জোরালো হচ্ছে।
ভারতে অনলাইন বেটিং প্ল্যাটফর্মের ব্যবহারকারী সংখ্যা নিয়ে আশঙ্কার সুর শোনা যাচ্ছে, অনুমান, প্রায় ২২ কোটি মানুষ কোনও না কোনও ভাবে এই অ্যাপগুলিতে যুক্ত, এর মধ্যে ১১ কোটির বেশি নিয়মিত ব্যবহারকারী। রেগুলেটরি সংস্থাগুলি বলছে, এর সামাজিক এবং আর্থিক প্রভাব বড়, বিশেষ করে অপরাধী চক্র অর্থ পাচার এবং ট্যাক্স এড়াতে এই ইকোসিস্টেমকে কাজে লাগাতে পারে। বিজ্ঞাপন ও ইনফ্লুয়েন্সার মার্কেটিং এই চক্রকে গণগ্রাহ্যতা দেয়, সেটিও নজরে। ফলে কনটেন্ট প্ল্যাটফর্ম, এজেন্সি, এবং তারকারাও জবাবদিহির আওতায় আসছেন। একই সঙ্গে সাধারণ ব্যবহারকারীদের জন্য সচেতনতা প্রচার বাড়ানোর কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আইনগত ঝুঁকি এবং ভোক্তা সুরক্ষার বিষয়টি সামনে থাকছে। প্রযুক্তি কোম্পানিরও মনিটরিং নীতিতে পরিবর্তন আসতে পারে।
আজ অঙ্কুশ হাজরার জিজ্ঞাসাবাদে যে বিষয়গুলি উঠে আসতে পারে, তা হল, সংস্থার সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ কবে, মধ্যস্থতায় এজেন্সির ভূমিকা ছিল কি না, পারিশ্রমিক কীভাবে ও কোথায় জমা হয়েছে, এবং কোনও পারফরম্যান্স বোনাস বা অতিরিক্ত পেমেন্ট ছিল কি না। চুক্তির মেয়াদ, ব্র্যান্ড গাইডলাইন, এবং কনটেন্টের অ্যাপ্রুভাল প্রক্রিয়া কী ছিল, তাও দেখা হবে। প্রচারের সময় কোনও কমপ্লায়েন্স নোট বা আইনগত ডিসক্লেমার রাখা হয়েছিল কি না, তাও প্রশ্নের তালিকায়। সোশ্যাল পোস্ট বা ভিডিওর ইউআরএল, র’ ফুটেজ, এবং ইনভয়েসের কপি চাওয়া হতে পারে। ব্যাংক স্টেটমেন্টে পেমেন্টের উৎস মিলিয়ে দেখবে ইডি। প্রয়োজনে এজেন্সির অফিসারদেরও মুখোমুখি করা হতে পারে। সব শেষে, নথি এবং বয়ান মিললে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক হবে। আজকের পর আরেক দফা ডাকা হতে পারে।
তদন্তকারীরা এও দেখছেন, বিজ্ঞাপন ছাপা বা প্রচারের আগে মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি কতটা সতর্কতা নিয়েছিল, ব্র্যান্ডের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক হয়েছিল কি না, এবং পলিসি অনুযায়ী বাছাই হয়েছিল কি না। প্ল্যাটফর্মগুলির বক্তব্য নথিবদ্ধ করা হচ্ছে। বড় টেক প্ল্যাটফর্মগুলির বিজ্ঞাপনী নীতিতে যে আপডেট এসেছে, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। স্থানীয় পাবলিশারদের ক্ষেত্রেও এথিক্স কোড মানা হচ্ছে কি না, তার জবাব চাওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপন বন্ধের নির্দেশ কতটা কার্যকর, মাঠের বাস্তবতায় তার প্রভাব কেমন, সেটিও তদন্তের অংশ। বিজ্ঞাপন রিভিউ টুলে বেটিং সম্পর্কিত কিওয়ার্ড ফিল্টার কেমন কাজ করছে, তা নিয়ে প্রযুক্তিগত তথ্য চাওয়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত, দায়বদ্ধতা একাধিক স্তরে ভাগ হবে। আইন ভাঙা না হলে শাস্তির প্রশ্ন উঠবে না।
বিনোদন জগতে এই জিজ্ঞাসাবাদের ঢেউ স্পষ্ট, কেবল অভিনেতা নন, ক্রীড়াবিদ, ইনফ্লুয়েন্সার, এবং মিউজিক ভিডিও ফেসরাও নজরে। ব্র্যান্ড এন্ডোর্সমেন্টের বাজারে এথিক্স চেক এখন কেন্দ্রীয় বিষয়। বহু তারকা ইতিমধ্যেই লিগ্যাল টিমের সঙ্গে পুরোনো চুক্তি খতিয়ে দেখছেন। কিছু ক্ষেত্রে ব্র্যান্ডকে টেকডাউন নোটিস পাঠানো হয়েছে। স্বেচ্ছায় ভিডিও বা পোস্ট মুছে ফেলা হচ্ছে। নতুন কনট্র্যাক্টে রেগুলেটরি ব্রিচ হলে দায় ভাগাভাগির ক্লজ যোগ হচ্ছে। এজেন্সিগুলিও ভেরিফিকেশন প্রোটোকল আপডেট করছে। বিজ্ঞাপনের আগে আইনি ক্লিয়ারেন্স চাওয়া হচ্ছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিজ্ঞাপন করা মাত্রে অপরাধ নয়, তবে অবৈধ পরিষেবাকে সচেতনভাবে প্রচার করলে দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। প্রমাণের ভার থেকে যায় তদন্তকারী সংস্থার ওপরেই। চুক্তি, পেমেন্ট, এবং অভিপ্রায়ের প্রমাণ মিললে তবেই ফৌজদারি ধারায় এগোনো সম্ভব। না হলে প্রশাসনিক বা আর্থিক জরিমানার পথে যাওয়া হয়। সেলিব্রিটিরা সাধারণত এজেন্সির ওপর নির্ভর করেন, তবু ডিউ ডিলিজেন্সের দায় তাঁদেরও আছে। ভবিষ্যতে এই কেস আইনগত রেফারেন্স হয়ে যেতে পারে। নীতিনির্ধারণে এর প্রভাব পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। তাই সতর্কতা আর স্বচ্ছতাই মূল মন্ত্র।

